রাখাইনে প্রায় সব শহরই দখলে নিয়েছে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বিদ্রোহীরা। রাজ্যটির মংডু শহর দখলের মধ্য দিয়ে আরাকান আর্মি এখন বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ২৭০ কিলোমিটারের বেশি সীমান্তের পূর্ণ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেছে। এ অবস্থায় দেশের নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে করণীয় কী হবে, সে ব্যাপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে ভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগ করে আলোচনায় বসা উচিত বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, মিয়ানমারের ভেতরে খণ্ডিত সার্বভৌমত্ব সবসময়ই ছিল। তারা বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল। মেজরিটি কমিউনিটির মধ্যে একটা মিয়ানমার মিলিটিরি বা তাতমাদো (সামরিক বাহিনীর বৃহত্তম শাখা), আরেকটি ইডিএফ—এদের মধ্যে যেহেতু ভাঙন বা তারা খণ্ডিত হয়ে গেছে, তাই আরাকান আর্মিসহ বাকি গোষ্ঠীগুলো সহজেই তৎপরতা চালাতে পারছে। তবে এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দরকার। বিষয়টি এমন নয় যে, এক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক করেছি, মানে অন্য পক্ষের সঙ্গে ছিন্ন করছি। তাতমাদোর সঙ্গে আলোচনা হলে বাকি গোষ্ঠীর সঙ্গেও করা যেতে পারে। কারও সঙ্গেই সম্পর্ক নষ্ট করা ঠিক হবে না ।
তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে দেখা দরকার আরাকান আর্মিদের কোনো সাহায্য দরকার কি না বা তাদের যদি প্রয়োজনীয় কিছু থাকে। যেহেতু তারা আরাকানে তাদের সার্বভৌমত্ব বাড়িয়েছে, তাই তাদের অনেক কিছুই দরকার হতে পারে। তাদের চিকিৎসা এবং নানা প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে যদি সাহায্য করতে হয়, সেক্ষেত্রে তার বিনিময়ে আমাদের কীভাবে কী দেবে, সেটা ঠিক করে নেওয়া দরকার। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে জরুরি হলো রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ। কীভাবে একটা কাঠামো তৈরি করা যায়, যেখানে তাতমাদো বা আরাকান আর্মি মনে করবে যে রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে তাদেরও লাভ। এটা আলোচনার মধ্যে আনা দরকার।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, সরকারিভাবে আমাদের সম্পর্ক বজায় আছে মিয়ানমারের সেনা সরকারের সঙ্গে। মংডু বাংলাদেশের অনেক নিকট অঞ্চল। ভারত-চীন মিয়ানমারের নিকটের দেশ হলেও তাদের দেশে কিন্তু এভাবে রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়নি। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের হিসাবটা ভিন্ন। বাংলাদেশ প্রান্তেও লাখ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, তাদের দেশের সাইডেও রয়েছে। যতটুকু জানি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্ক ভালো না। তবে বাস্তবতা আমাদের বর্ডারের কাছেই তাদের এলাকা। তাই আরাকান আর্মির সঙ্গে নানা চ্যানেলে আমাদের যোগাযোগটা রাখা উচিত। আমাদের সীমান্তে রোহিঙ্গা নিয়ে যে বাস্তবতা, তা নিয়ে অবশ্যই কথা বলা উচিত।
তিনি আরও বলেন, আরাকান আর্মি ধীরে ধীরে যদি সব দখল করতে থাকে, তাহলে তাদের সঙ্গে এমনিতেই আমাদের যোগাযোগ রাখতে হবে। তবে এটা করতে হবে দৃষ্টি গোপন করে।
রোহিঙ্গারা যেন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও অনুপ্রবেশ না করতে পারে সেক্ষত্রে আমাদের নজর দিতে হবে উল্লেখ করে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীকে এখন সীমান্তে পাঠাতে হবে। তাদের ছাড়া প্রকৃত নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব না। সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা না দিলে রোহিঙ্গারা আরও ঢোকার পরিকল্পনা করবে। তাই সীমান্তে সেনাবাহিনী পাঠাতে হবে। দেশে আর একজন রোহিঙ্গাকেও ঢোকানো উচিত হবে না।
তবে আরাকান আর্মির সঙ্গে বসা বা আলোচনার বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত একেএম আতিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের চলমান এ পরিস্থিতি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা ওদের সঙ্গে বসে কীভাবে সমাধান করবে, সেটা মিয়ানমারের বর্তমান সরকার আর আরাকান আর্মি বুঝবে। এক্ষত্রে তাদের দেশে যে অরাজকতা চলছে তা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের ভাবনার চাইতে তাদের ভাবনা বেশি। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তাদের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে সেগুলো কখনো কার্যকর হয়নি। বারবার রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এক টেবিলে দুপক্ষ কথা বললেও কাজ হয়নি। এ ছাড়া আমরা ভেবেছিলাম, আন্তর্জাতিক মহল বা আমাদের দুদেশের শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত ও চীন সাহায্য করবে। সবাই অনেক আশ্বাস দিলেও কার্যত এর কোনো ছিঁটেফোটা আমরা দেখিনি।
আরাকান আর্মির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তো আমাদের রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান হবে না। আমাদের চিন্তার কারণ আমদের প্রতিবেশী কমন বর্ডার আছে। রোহিঙ্গা এখানে আছে, আরাকান আর্মি জানে। তারা জানলেও তাদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে সুরাহা করার কিছুই নেই। মনে হয় না, আমাদের ক্ষতি হয় এমন ভয়ংকর কিছু করবে তারা। তাদের মঙ্গল ও সেফটির জন্যই তারা বিরোধে যাবে না।
বর্ডারে নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রয়োজন কি না—এমন প্রশ্নে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বর্ডারে যারা আছে, তারা অবশ্যই সব পর্যবেক্ষণ করছে। তারা যদি নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করে, তাহলে অবশ্যই সেটা লক্ষ্য রেখে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার দেখি না।
আরকান আর্মিদের মংডু দখল নেওয়ায় বাংলাদেশ সীমান্তে হুমকি দেখছেন কি না জানতে চাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হকের কাছে। তিনি বলেন, আরাকান আর্মিদের জন্য বর্ডারে কোনো হুমকি আছে বলে আমি মনে করি না। যারা বর্ডারের দায়িত্বে আছে আশা করি তারা বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে। তবে বর্ডার সুরক্ষা মানেই যে শুধুমাত্র বাইরের শক্তি আক্রমণ করবে, এমনটা নয়।
তিনি বলেন, আমাদের আচরণ প্রো-অ্যাকটিভ নয়, বরং রিয়েকটিভ। কারণ, মংডুর আগে বাংলাদেশের নিকটবর্তী আরও কয়েক এলাকা দখল নেয় বিদ্রোহীরা। তখন আমাদের কি কোনো প্রস্তুতি ছিল? যে গতিতে দখল নিচ্ছে আরাকান আর্মি, সে হিসেবে মংডুর পতন হলে কী হবে, আমাদের কি সেই প্রস্তুতি ছিল! এখানে সমন্বয়ের সমস্যা আছে। কী হচ্ছে আমরা প্রকৃত অর্থে জানি না। ফলে আমাদের কাছেও পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। রোহিঙ্গা নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। প্রচুর কথা হয়েছে। অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এখান থেকে আমাদের লার্নিংটা কী। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তো পলিসি চলমান থাকা উচিত। আমাদের পলিসিটা আসলে কী। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পলিসি রিভিউ করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পলিসি রিভিউ তো একটি চলমান প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। একটা কোর গ্রুপ থাকা দরকার। রেগুলার আপডেট রাখবে কোর গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করবে এবং দেখবে কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
পাঠকের মতামত